প্রখর তাপ
– রাখী চক্রবর্তী
মালতীর মা অখিলা খুব সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে পড়ে। দুই বাড়ি কাজ সেরে তাও নিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। তখন রোদের প্রখর তেজে মালতীর মার চোখের সামনে নীল, সবুজ, লাল রঙের বর্ণরা খেলা করে। নিজের মেয়ের ওপর তখন বিতৃষ্ণা বাড়ে অখিলার। মেয়ে যেন অখিলার পাপের ফসল।
গত পরশু অখিলা বিনিদের বাড়িতে একটু দেরি করে গেল। শরীরটা বড্ড খারাপ ছিল অখিলার। কিন্তু কাজে যেতেই হবে, বিনিকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। অখিলা দশটার সময় বিনিদের বাড়িতে গেল। সদর দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু ঘরে কেউ নেই। অখিলা ভাবছে সব ঠিক আছে তো। কারোর টু শব্দ নেই। নানান কথা ভাবতে ভাবতে বাসন ধুয়ে ঘর মুছতে গেল। ঘর সুন্দর করে সাজানো।ফুলের গন্ধে মো মো করছে।
এমন সময় বিনির বাবা দোতলার থেকে নেমে এসে বললো, অখিলা ঘর মুছে জলখাবার রেডি করো। আমরা আসছি।
-দাদাবাবু আপনারা কোথাও যাচ্ছেন?
বিনির বাবা বললো, না না বিনিকে দেখতে ওরা চলে এসেছে।
— ওও..কোথায় ওনারা?
– সব ছাদে রোদ পোহাচ্ছে।
– এই গরমে ছাদে?
– হ্যাঁ রোদে থাকলেই তো ভিটামিন ডি তৈরি হবে। তাই। নাও তাড়াতাড়ি কর।
অখিলা ঘর মুছতে মুছতে ভাবছে তাহলে আমার মতো গরিব মানুষেরাও ভিটামিন পায় বিনে পয়সায়। না ফল.. না দামি দামি খাবার।
অদৃষ্টের খেলা দেখো। মাইলের পর মাইল রোদে হেঁটে আমি কাজ করতে আসি লোকের বাড়ি। খিদের জ্বালা তাও মেটে না।তারপর প্রখর রোদের তেজ। ঘামাচির চুলকানি। সব নিয়ে দিশেহারা। বড়লোকদের রোদে হাঁটতে হয় খেয়াল বশে। কি লীলা ভগবান তোমার।
অখিলা ঘর মুছছে এসি বন্ধ, পাখাটাও বন্ধ করে দিয়েছে বিনির বাবা। অনেক দিন বলেছে পাখাটা চালিয়ে দিন ঘরটা শুকিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। কিন্তু কে শোনে কার কথা।রোজের নিয়ম আজও অব্যাহত। শরীর যেন আর চলছে না অখিলার। জলখাবার তৈরি করে তিনতলার ছাদে দিতে গিয়ে থমকে গেল অখিলা, কোথায় রোদ! তেমন তেজ নেই তো রোদের। কি সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।বিনি সেজে বসে আছে। খুব সুন্দর লাগছে।পছন্দ তো হবেই। মালতীর মতো কুরুপা নাকি। আমার যা কপাল একটিই মেয়ে আমার, একটু যদি সুন্দর হতো। অদৃষ্ট সব অদৃষ্ট।
– অখিলা নিয়ে এসো আরো খাবার।
অখিলা ছাদ থেকে কিছুতেই নামবে না।কাজের ছলে ঘুরছে, রোদে ঘুরেও সুখ আছে। হাল্কা রোদের পরশ গায়ে লাগতেই অখিলা শাড়ির আঁচলটা ছেড়ে দিলো।হাওয়াতে চুলগুলো উড়ছে। এই মূহুর্তে অখিলা কাজের দিদি, কাজের মেয়ে কোন সম্বোধন শুনতে চায় না। নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছে ওর। গুনগুন করে গান ধরেছে অখিলা। সবাই তো খেতে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পর অখিলা দাদাবাবুর চিৎকারে হুঁশে এল।
– কি হয়েছে দাদাবাবু?
– খাবার দিলে, জল কোথায়?
– ও ভুল হয়ে গেছে দাদাবাবু এখুনি নিয়ে আসছি।
নিচের ঘর থেকে জলের গ্লাস নিয়ে যাবার সময় অখিলা দেখল মালতী দরজার সামনে বসে আছে।
– মরণ দশা আমার। আমার খুশিতে তোর গা জ্বলে তাই না। কোথায় একটু ছাদে দাঁড়িয়ে নায়িকা নায়িকা ভাব দেখাবো। গেল সব গেল..মনে মনে গজরাতে গুজরাতে অখিলা বললো, তুই এখানে?
– মা তোমার শরীরটা ভালো না আমি তোমাকে নিতে এসেছি। এই দেখো ছাতা নিয়ে এসেছি।
অখিলা চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর বললো, একটু বস আমি আসছি ।
জলের গ্লাস দিয়ে অখিলা নিচে নেমে এলো। অখিলা অনিচ্ছা স্বত্বেও মেয়ের সাথে হাঁটা দিলো।
মেয়ে মার মাথার ওপর ছাতা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাকে জড়িয়ে ধরে। অখিলার দু’চোখ জলে ভরে গেল। রূপ নেই তো কি হয়েছে মেয়ে আমার খাঁটি সোনা।
মালতি বলছে জানো মা, একশো দিনের কাজ পেয়েছি আমি।
টাকা জমিয়ে তোমার জন্য সিলিং ফ্যান কিনবো। রোদে তেতে তোমাকে আর কাজে যেতে হবে না।
ফ্যান চালিয়ে ঘরে বসে আরাম করবে তুমি।
অখিলা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোকেও তো রোদে পুড়ে কাজ করতে হবে মা। তুই ঘরে থাকবি। আমি কাজে যাব। তোর বিয়ে দিতে হবে। সুন্দর করে সাজবি, সানাই বাজবে, ফুল গুজবি খোঁপাতে।
শ্বশুর ঘর করবি মা, আমি বেঁচে থাকতেই তোর বিয়ে হবে। বৌ হবি বৌ..
সূর্যের রশ্মির প্রখর তাপে মা মেয়ের মুখ দু’টি লাল বর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েরটা লজ্জায় আর মায়েরটা মেয়ের বিদায় নেওয়ার ভয়ে। আজ অখিলার সারা শরীর জুড়ে প্রখর তাপ। এ তাপে অখিলা শুদ্ধ হলো। কুরুপা সন্তানের জন্য গর্ব হল অখিলার। অখিলার অদৃষ্ট কপালে আজ থেকে মেয়েকে সুপাত্র করার চিন্তার ভাঁজ পড়লো।